চির সজীব মানুষের প্রতিচ্ছবি সাংবাদিক নেতা মোজাম্মেল হক
মুহাম্মদ বাকের হোসাইন :
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসেন যারা জীবনকে পার্থিব জটিলতা থেকে দূরে রেখে নিজের মতো করে গড়ে তোলতে পারেন। শত যন্ত্রণার বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারায় জীবন তাদের অনুগত হয়ে যেতে বাধ্য হয়।এধরনের লোকগুলো দুঃখের মাঝেও অমলিন হাসতে পারেন, উদ্বেগেও নির্বিকার থাকেন।বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা মরহুম মোজাম্মেল হক ছিলেন সে ধরনের এক মানুষ। আজ ৫ ডিসেম্বর তাঁর ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।২০০৯ সালের এই দিনে ফিলিপস পুরস্কার পাওয়া এই সাংবাদিক নেতা আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান। মৃত্যুর কিছুদিন আগে অসুস্থ মোজাম্মেল হক হুইল চেয়ারে চড়ে তাঁর প্রিয় অঙ্গন জাতীয় প্রেসক্লাবে সহকর্মীদের দেখতে এসেছিলেন। সেটাই ছিলো শেষ দেখা। দিনটি ছিলো খুবই বেদনাবিধুর,কারণ তিনি সহযোদ্ধাদের সামনে অঝোর নয়নে কেঁদেছিলেন।হয়তো তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন সাংবাদিকদের প্রিয় প্রাঙ্গণে এটাই তাঁর আখেরি সফর। সহকর্মীরাও সেদিন তাঁর অসহায় কান্না দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন। যেই মোজাম্মেল হকের সরস আড্ডা উপভোগের জন্য সবাই মুখিয়ে থাকতেন তার এই করুণ দশা সবাইকে মর্মাহত করেছিলো।
মোজাম্মেল হক ছিলেন মিতভাষী। তিনি কথা বলতেন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু রসিকতায় ভরা,কারো সাথে রাগত স্বরে কথা বলতে তাঁকে কখনো দেখা যায়নি। বিরক্ত হয়ে যে কথা তিনি বলতেন তা শুনেও মানুষের হাসি পেতো।কথার মতো তাঁর লেখাও ছিলো সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাতে সারবত্তা থাকতো ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘প্রিভিটি ইজ দ্য মাদার অব উইজডম’ অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বলাই জ্ঞানীর লক্ষণ, তিনি ছিলেন তাই। জীবনে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু কখনো রাশভারি হননি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।তিনি প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার তথ্য সচিব নিযুক্ত হন।সরকারি দায়িত্ব পালনের মাঝে ফুরসত ফেলেই জাতীয় প্রেসক্লাবে এসে আড্ডা জমিয়ে দিতেন। তখনো বোঝা যেতোনা তিনি প্রেসক্লাবের নেতা না-কি গণতান্ত্রিক সরকারের তথ্য সচিব। তাঁর আচরণে কোনো পরিবর্তন কখনো কেউ দেখেনি।একবার সহকর্মীদের কেউ একজন তাঁকে এসম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন প্রেসক্লাবে ঢোকার আগে তথ্য সচিবগিরি তিনি বাইরে রেখে আসেন।এগুলো মানুষের বড়ত্ব।
তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন।সভাপতি থাকা অবস্থায় তথ্য সচিবের দায়িত্ব পান। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের মহাসচিব ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি। তিনি ইসলামিক টেলিভিশনের পরিচালক (বার্তা) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কখনো কারো সাথে কখনো রূঢ় আচরণ করেননি।নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রচারণা ও ভোটের উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেও তিনি হাসি-রসিকতা করতেন। তাঁকে কঠিন হওয়ার পরামর্শ দিয়েও কখনো কঠোর বানানো যায়নি।
মোজাম্মেল হক ছিলেন পরোপকারী এক মানুষ কিন্তু কারো উপকার করে তা প্রচার করতেন না। ছিলেন মানুষ চেনায় অতি দক্ষ,কিন্তু কাউকে চিনেও তার সাথে এতো সরস আচরণ করতেন যে ঐ লোক না হেসে পারতেন না। তিনি ছিলেন একজন নিখাদ জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার মানুষ কিন্তু কথাবার্তায় তা প্রকাশ পেতো লঘুভাবে, প্রকৃত প্রকাশ ঘটতো কাজে। ইসলামি টেলিভিশনে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে তিনি আমাকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাতে মোজাম্মেল হকের রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
মোজাম্মেল হকের আত্মমর্যাদা বোধ ছিলো অতি প্রখর। সাংবাদিক হিসেবে নিজের মর্যাদায় এতটুকু আঁচড় লাগুক তা তিনি কখনোই সহ্য করেননি।রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তিনি ছিলেন সবসময় সশ্রদ্ধ, কিন্তু তারপরও তথ্য সচিব থাকা অবস্থায় তাঁকে সচিবের মর্যাদা না দেয়ায় তিনি কিছুদিন বেতন নেয়া বন্ধ করে দেন। অবশেষে তাঁকে সেই মর্যাদা দেয়া হয়।
মোজাম্মেল ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু আমরা তাঁর সজীব হৃদয়ের ছোঁয়া অনুভব করি। তাঁর প্রাণবন্ত আড্ডার কথা মনে পড়লে আজকের জাতীয় প্রেসক্লাবকে বড়ই নিষ্প্রাণ ও বেসুরো মনে হয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই মোহতারামা ভাবি দিলরুবা হক,তাঁদের সন্তান,ভাই সাংবাদিক প্রবাসী নাঈমুল হকের প্রতি।
মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে সকাতর মুনাজাত মাবুদ আপনি নিজের গাফুর ও গাফফার নামের অছিলায় মোজাম্মেল ভাইকে ক্ষমা করে দিন,তাঁর গুনাহ-খাতা মাফ করে দিয়ে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন, আমিন।
মুহাম্মদ বাকের হোসাইন
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে





























