• ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ রবিবার রাত ৮:৪৬
S M Tajul Islam সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫

নুরাল পাগলের দরবারে হামলায় আহত অর্ধশতাধিক, প্রশাসনের ব্যর্থতায় ক্ষোভ

রাজবাড়ী : প্রশাসনের নানা উদ্যোগ ও একাধিক বৈঠক সত্ত্বেও অবশেষে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নূরাল হক ওরফে নুরাল পাগলের দরবার ও বাড়িতে হামলা ঠেকানো গেল না। আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর তৌহিদী জনতা বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে দরবার শরীফে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। শুধু তাই নয়, কবর থেকে লাশ তুলে মহাসড়কে এনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সদস্যসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

আজ দুপুরে গোয়ালন্দ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আনছার ক্লাব চত্বরে ইমান আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তব্য দেন উপজেলা ইমাম কমিটির সভাপতি মাওলানা জালাল উদ্দিন, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আইয়ুব আলী খান, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মন্ডলসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের নেতারা।

সমাবেশ শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা দরবারের দিকে অগ্রসর হতে চাইলে প্রশাসন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের গাড়ি এবং গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসির গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এতে ইউএনও, এএসপি শরীফ আল রাজিব ও ওসি রাকিবুল ইসলামসহ অন্তত ৭ জন পুলিশ আহত হন।

প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ জনতা দরবারে প্রবেশ করে। দরবার শরীফ ও নূরাল পাগলের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে তারা। একপর্যায়ে কবর খুঁড়ে মরদেহ উত্তোলন করা হয়। পরে সেটি ঢাকা খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় এনে মহাসড়কের পাশে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে বিক্ষুব্ধরা।

ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও র‍্যাব পৌঁছালেও সহিংসতা ঠেকাতে পারেনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত এলাকায় থেমে থেমে উত্তেজনা বিরাজ করে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাহিদুর রহমান বলেন, “আমরা বারবার চেষ্টা করেছি সংঘাত এড়াতে। দরবার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আলেমদের দাবি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। তবুও জনতা আক্রমণ করেছে। আমাদের সরকারি গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।

গোয়ালন্দ থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম সমাধান হয়ে গেছে। কারণ কয়েক দফা বৈঠকে উভয় পক্ষই একমত হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা হঠাৎ করেই সহিংস হয়ে ওঠে। এসময় আমি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন আহত হই।”

গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. শরিফুল ইসলাম জানান, “আমাদের হাসপাতালে ২২ জন আহত রোগী এসেছে। তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে, বাকিদের ফরিদপুর মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।”

ঘটনার আগে শুক্রবার বেলা ১১টায় গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবে দরবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, আলেম-ওলামাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে কবর নিচু করা হয়েছে, দেয়ালের রং পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ইমাম মেহেদি দরবার শরীফ লেখা সাইনবোর্ড সরানো হয়েছে।

ভক্ত মেহেদি আল আমিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা ইসলামের সব নিয়মকানুন মেনে চলছি। এখানে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অভিযোগ ভিত্তিহীন। প্রশাসনের সহযোগিতায় দাবিগুলো মানা হয়েছে।”

জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামও দরবার পরিদর্শন শেষে বলেন, “আলেমদের দাবির মধ্যে কবর নিচু করা হয়েছে। তাই মূল দাবি মেনে নেওয়ায় আগামী শুক্রবারের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তবে আজকের ঘোষিত বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হবে।”

আশির দশকে নূরাল পাগল নিজেকে ইমাম মেহেদি দাবি করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৩ সালে আন্দোলনের মুখে এলাকা ছাড়লেও পরবর্তীতে আবার দরবার চালু করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কাবা শরীফের আদলে উঁচু বেদি নির্মাণ করেন। গত ২৩ আগস্ট মৃত্যু হলে তাকে ওই বেদিতে দাফন করা হয়। আলেম-ওলামাদের অভিযোগ, তাকে দক্ষিণমুখী মাথা দিয়ে দাফন করা হয়েছে, যা ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী। এছাড়া তার ছেলে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করছে বলেও অভিযোগ ওঠে, যা জনমনে ক্ষোভ বাড়ায়।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো—প্রশাসন একাধিক বৈঠক করে আলেম-ওলামাদের দাবির আংশিক সমাধান করলেও জনমনে যে ক্ষোভ জমে ছিল, তা প্রশমিত হয়নি। উল্টো সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পক্ষগুলোর তীব্র চাপের মুখে সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নেয়।

প্রশ্ন উঠছে— প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো কেন?

যখন আলেম-ওলামাদের দাবি পূরণ হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল, তখনও কেন বিক্ষোভকারীরা থামেনি?

নুরাল পাগলের দরবারকে ঘিরে দীর্ঘদিনের বিতর্ক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। লাশ উত্তোলন ও পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা বাংলাদেশে বিরল। প্রশাসনের উপস্থিতিতে এমন সহিংসতা ঘটায় ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও।

গোয়ালন্দে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশ টহল জোরদার করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *