• ২১শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬:১২
S M Tajul Islam আগস্ট ২১, ২০২৫

ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে?

আতিকুর রহমান রুমন : শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন ফ্যাসিস্ট হাসিনা হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে শোনা যেত ‘ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা দুবাইয়ের মতো।’

কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সতর্ক বার্তাকে উপেক্ষা করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করে। ধাপে ধাপে ভারত শুধু সড়ক নয়, রেল ট্রানজিটও আদায় করে নেয়। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং নৌপথ ব্যবহার করে আখাউড়া-আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে পৌঁছাচ্ছে। এছাড়া ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বাংলাদেশের পূর্বদিক হয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় এই ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে? সোজা উত্তর—না, হয়নি। বরং, দৈনিক আজকালের খবর পত্রিকার (৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে ১৬ বছরে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা, অথচ কেবল ট্রানজিটের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়েই খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।’ অর্থাৎ, যে ট্রানজিটকে উন্নয়নের সোনার হরিণ বলা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল আর্থিক ক্ষতি এবং জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রতীক।

শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন, তা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে ইতিহাসে। ক্ষমতার লোভে আঞ্চলিক শক্তির কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পাচার করেছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা (দৈনিক সমকাল, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪)। শুধু গত পাঁচ বছরের পাচারের অঙ্কই জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এই অর্থ দিয়ে ৮৭টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল।

২০০৯ সালে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের সময় সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ কোটি টাকায়। মাথাপিছু ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে বিদেশি ও দেশি উৎস থেকে, যার বিশাল অংশ লুটপাট হয়েছে মেগা প্রকল্পের নামে। আর এই লুটপাটের কেন্দ্রে ছিল শেখ পরিবার।

২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। টানা ১৬ বছর শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাওয়া বিএনপি হয়তো এককভাবে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু রাজপথ আন্দোলনের জন্য সবসময় প্রস্তুত রেখেছিল। তার পথ ধরেই সারা দেশের ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে। এই গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে রাজপথে অটল থাকার নির্দেশ দিয়ে গণঅভ্যুত্থানকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যেতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনন্য ভূমিকা পালন করেন। স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি পায় বাংলাদেশ।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারেই নয়, নিজের যোগ্যতায় আজ দেশের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সবচেয়ে ভরসার স্থল। দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় প্রবাসে থেকেও তিনি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিটি আন্দোলনে প্রেরণার উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। তার ডাকেই গত দেড় দশকে সংগঠিত হয়েছেন বিএনপির লাখো নেতাকর্মী, জেগে উঠেছে ছাত্রসমাজ, রাজপথের আন্দোলনে কেঁপে উঠেছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের ভিত। স্বৈরশাসন-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে দেশ যখন নতুন পথের সন্ধানে, তখন জনমানসে এই প্রত্যাশা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে যে, তারেক রহমানের নেতৃত্বেই শুরু হবে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়।

গত ১৬ বছরের শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপি এবং জিয়া পরিবারকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সাজানো মামলায় ফরমায়েশি রায় দিয়ে বছরের পর বছর তাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। নিষ্ঠুর এই নিপীড়ন সইতে না পেরে বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো এক বুক ব্যথা নিয়ে চলে গেছেন দুনিয়া ছেড়ে।

তার বড় ভাই তারেক রহমানকে ১/১১-এর সেনাসমর্থিত সরকার ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করে। কারাগারে তাকে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল তার জীবন শেষ করে দেওয়া। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত ও দেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ থেকে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান তারেক রহমান। তারপর আর তাকে দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

বাধ্য হয়ে তাকে ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হচ্ছে। ফলে প্রিয় ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর সময় তার মুখটি তিনি শেষবারের মতো দেখতে পারেননি। কিন্তু নির্বাসনে গিয়েও থেমে থাকেননি তিনি। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অটল অবস্থান নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং জনতার স্বপ্নকে জীবিত রেখেছেন।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বিএনপির ১ হাজার ৫৫১ নেতাকর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে ৪২৩ জনকে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দেড় লাখেরও বেশি মামলায় আসামি করা হয় বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মীকে। ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন বিএনপির ৪২২ জন নেতাকর্মী।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার পেছনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসী মনে করেন, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠন করে তারেক রহমানের নেতৃত্বই বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ১৯৮৯ সালে বগুড়ায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে তারেক রহমানের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয়। সেখান থেকে শুরু করে তিনি নিরলসভাবে দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে কাজ করে গেছেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকর প্রচার কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখে রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন।

তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হলো শিষ্টাচার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা। এই গুণাবলিই তাকে আদর্শবান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন কথার রাজনীতি নয়, পরিবর্তন চায় আর সেই পরিবর্তন ঘটুক বিএনপির হাত ধরে—এ প্রত্যাশাই জনমানসে প্রবল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির গত ৭ আগস্ট এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশকে সত্যিকারের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে নেতৃত্ব দিতে চান তারেক রহমান।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল।

সূত্র : আমার দেশ অনলাইন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *