
এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী ও জাতীয় স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ জনবুদ্ধিজীবী
ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রয়াত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী ও জাতীয় স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ জনবুদ্ধিজীবী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ১/১১-এর কঠিন সময় পর্যন্ত তিনি নির্ভীক কণ্ঠে অন্যায় ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন।
শনিবার (২৬ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে এমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টারের আয়োজনে তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তব্য দেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও এমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টারের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম।
তিনি বলেন, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বা জনবুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্যের বিচারে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের অগ্রজ জনবুদ্ধিজীবী। তিনি ছিলেন আলোকিত মানুষ, জ্ঞানের সমুদ্রতীর্থ ও জাতির বিবেক।
তিনি উল্লেখ করেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে এমাজউদ্দীন আহমদের সাহসী ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী। সামরিক শাসনের কুফল প্রথম সরাসরি তিনি তুলে ধরেন এবং দুই নেত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার সময় সাহসী বিবৃতি দেন। মানবাধিকারের লঙ্ঘন, গণতন্ত্র বিপন্ন বা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হলে সবসময় তিনি প্রতিবাদ ও আন্দোলনে অংশ নিতেন।
তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যখনই মানবাধিকারের ব্যত্যয় ঘটেছে, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে কিংবা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে, তখনই তিনি প্রতিবাদ ও আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ হলে, ট্রাকের চাকায় গণতন্ত্র পিষ্ট হলে কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে তিনি সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন। তিনি কোনো দল, গোষ্ঠী বা পক্ষের রাজনীতি করেননি; বরং নিজস্ব স্বকীয় ধারায় দেশপ্রেমপ্রসূত একজন নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যিনি গণতন্ত্রকে জাতির জীবনরেখা মনে করতেন। এই স্বাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হয়েছে, বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে, পরিবার অন্যায়ের শিকার হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিব্রত হয়েছেন, তবুও অবিচলভাবে ধৈর্য ও সাহসে বৈপরীত্যের মোকাবিলা করেছেন।
এর আগে স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বাবার সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন, বুদ্ধিজীবী মহল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জগতে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অনন্যসাধারণ, বহুমাত্রিক এবং বিরল প্রতিভাধর এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন ও কর্ম যেমন ছিল বিস্তৃত, তেমনি মানবিকতায় পরিপূর্ণ। তিনি প্রাঞ্জল, তথ্যনির্ভর এবং মানবিক ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর শব্দ ছিল পরিমিত, কিন্তু বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বলতেন। ছিলেন নির্ভীক এবং বুদ্ধিজীবী সমাজের অগ্রদূত।
তিনি আরও বলেন, যখন বিএনপির কোনো বুদ্ধিজীবী সংগঠন ছিল না, তখন তিনি ৯০-এর দশকে ‘শত নাগরিক’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন, যাতে বিএনপিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া যায়। তাঁর নেতৃত্বে গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা দিকনির্দেশনা উঠে আসে। তিনি জাতিকে আলোকিত করেছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
ব্যক্তিজীবনে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বেগম সেলিনা আহমদকে বিবাহ করেছিলেন। তাদের পাঁচ সন্তান ও সাত-আটজন নাতি-নাতনি নিয়ে ছিল একটি সুখী পরিবার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারিবারিক, বিনয়ী ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। বিশাল পান্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও কখনো অহংকার করেননি, কাউকে ছোট করেননি। সবাইকে বন্ধু ও সহকর্মী হিসেবে দেখতেন, ছোটদের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন এবং তাঁদের কল্যাণকামী ছিলেন। আমি সবার কাছে বাবার জন্য দোয়া চাই—আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসিব করেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মেজবাহ উল-আজম সওদাগর। অনুষ্ঠানের শুরুতে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. এনায়েত উল্লাহ পাটোয়ারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক স ম আলী রেজা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামছুল আলম সেলিম, এমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টারের অন্যতম উদ্যোক্তা বিশিষ্ট শিল্পপতি ও লেখক আবুল কাসেম হায়দার, এমাজউদ্দীন আহমদের ছেলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক জিয়া আহমদ, নাতনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বুশরা মাহজাবীন, আরেক নাতনি পিএস-এনগেজ এর সিনিয়র অ্যাডভাইজার শাফকাত সিদ্দীকাসহ প্রমুখ।