• ২০শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বুধবার রাত ৪:১৮
S M Tajul Islam জুন ৮, ২০২৫

হঠাৎ ভোররাতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস

জাজিরা (শরীয়তপুর): ঈদের সকালে যখন গোটা দেশ কোরবানির উৎসবে মেতেছে, তখন পদ্মা তার ভয়াল রূপে আছড়ে পড়েছে শরীয়তপুরের জাজিরার বুকজুড়ে। এক ফোঁটা আনন্দ নয় বরং কেবলই কান্না, আতঙ্ক আর সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণায় কাতর নদীপাড়ের মানুষ।

হঠাৎ ভোররাতে শুরু হওয়া ভাঙনে পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের আড়াইশ’ মিটার অংশ নিমিষেই গিলে নেয় অন্ধকার জলের অতল গহ্বরে। এ যেন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, যেন পদ্মা নিজেই প্রতিশোধ নিতে নেমেছে।

ভাঙন ঠেকানো না গেলে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে রাস্তাঘাট, হাটবাজারসহ শতাধিক ঘরবাড়ি। দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি স্থানীয়দের। আর ভাঙন রোধে জিওব্যাগ ডাম্পিংয়ের কথা জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় মাঝিরঘাট থেকে পূর্ব নাওডোবা পর্যন্ত নির্মিত হয় প্রায় ২ কিলোমিটার দীর্ঘ রক্ষা বাঁধ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এই প্রকল্পে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ধসের শুরু হয়।

গত বছরের নভেম্বরেই নাওডোবা এলাকায় ১০০ মিটার বাঁধ ধসে যায়, যার পুনর্নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যয় করে আরও ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এবার সেই সংস্কার করা এলাকাসহ আরও একটি স্থান একদিনেই ধসে গেছে নদীতে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর পূর্ব পাশের নদীর গভীরতা বাড়ায় পুরো বাঁধ এখন চরম ঝুঁকির মুখে।

মাঝিরঘাট বাজারে প্রায় ২০০ দোকান। সবই এখন ভাঙনের মুখে। ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, দোকানে দুই দিন আগেই নতুন মাল এনেছি ঈদের বিক্রির জন্য। এখন সবই শেষ। দোকানটা নদীতে চলে গেলে কী করব? আমাদের ঈদ শেষ নয়, জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে!

জাজিরার মাঝিরঘাট এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, গতকাল ঈদের জন্য ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু এবার কোনো ঈদ হলো না। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নদী আমাদের ঘর গিলে নিচ্ছে। ঈদের নামাজ পড়া তো দূরের কথা, ঘর সরাতে ব্যস্ত ছিলাম। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাব, জানি না।

ভাঙনের শিকার হওয়া দেলোয়ার হোসেন বলেন, আজকে ঈদের দিনেও আমার কোনো ঈদ নেই। আমার বাড়িঘর সব পদ্মা নদীতে ভাইঙ্গা লইয়া যাইতেছে। ঘরবাড়ি সরাইয়া সারতে পারছি না। আমি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অতি তাড়াতাড়ি এই জায়গায় যদি বস্তা না ফেলা হয় তাহলে পুরো এলাকা নদীগর্ভে চলে যাবে।

পদ্মা পাড়ের বাসিন্দা বাদশা শেখ বলেন, কয়েক বছর ধরে পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পাড়ের কাছে চলে এসেছে। আজ ভাঙনের ফলে রক্ষা বাঁধের দুটি স্থানে অন্তত আড়াইশ মিটার বাঁধ ধসে গেছে। এলাকাবাসী খুব আতঙ্কে আছি। আমরা চাই নদীতে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধের পাশাপাশি শক্ত একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হোক।

মাঝিরঘাট বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, আমাদের এই বাজারে ২০০ দোকান আছে। পাকা ঘর, বিল্ডিং করা। আমাদের এগুলো সব ধ্বংস হয়ে যাবে। সরকারের কাছে দাবি, দ্রুত ভাঙন ঠেকানো হোক।

বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহল বলছেন, বারবার মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও পরিকল্পনার অভাব ও দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে পদ্মা পাড়ে কোনো স্থায়ী সমাধান আসছে না। রক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্যই ছিল নদীভাঙন রোধ। অথচ এখন সেই বাঁধই যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।

এদিকে নদী তীরে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে কাঁপতে থাকা মানুষগুলোর চোখে এখন একটাই প্রশ্ন- ‘আমাদের কী হবে?’ ঈদের দিন যখন পুরো দেশ আনন্দে মেতে উঠেছে, তখন শরীয়তপুরের জাজিরার মানুষ গৃহহীন হয়ে আশ্রয় খুঁজছেন অন্য কোথাও। এটা কেবল একটি বাঁধ ধস নয়, বরং সরকারের অবহেলা, পরিকল্পনার ব্যর্থতা এবং প্রকৃতির প্রতিশোধের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। পদ্মা এবার শুধু ঘর নয়, কেড়ে নিচ্ছে ঈদের আনন্দ, মানুষের স্বপ্ন এবং জীবনের নিরাপত্তা।

এদিকে ধসে পড়া বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর দ্রুত বাঁধটির ভাঙনে ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুমন চন্দ্র বনিকের। তিনি বলেন, আমরা খবর পেয়ে ভাঙনস্থল পরিদর্শন করেছি। অতি শিগগিরই ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *