সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পরিবেশ বাস্তবায়নে সাহসী পদক্ষেপ নিতেন
ঢাকা : খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না; তার জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল পরিবেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এই ভালোবাসাই তাকে দেশের পরিবেশনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সাহসী পদক্ষেপ নিতে প্রভাবিত করেছিল।
তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘পরিবেশ রক্ষা করা মানে মানুষকে রক্ষা করা’। সেই দৃষ্টিভঙ্গিই তার নীতিমালা, আইন এবং সামাজিক উদ্যোগের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো শুধু সরকারের আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা ছিল না; বরং এতে ছিল তার ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আবেগ—দেশের পরিবেশ, মানুষের সুস্থতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের জন্য।
১৯৯১ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খালেদা জিয়া জাতীয় পরিবেশনীতি ও আইন কার্যকর করেন, যা পরবর্তীতে দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং জাতীয় পরিবেশ নীতি ১৯৯২ এই সময়ের উল্লেখযোগ্য অর্জন। এসব আইনের মাধ্যমে শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নদী ও বন সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশগত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়।
সে সময় প্রণীত নীতিমালা আজও দেশের পরিবেশ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের জন্য খালেদা জিয়ার পরিবেশনীতি ছিল স্পষ্ট; শুধু আইনের বিধান নয়, মানুষকে সচেতন করা এবং সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তিনি সরাসরি স্কুল-কলেজ ও গ্রাম-শহর এলাকায় বৃক্ষরোপণ অভিযান, বন সংরক্ষণ এবং নদী পরিচ্ছন্নতার প্রচারণায় অংশ নিতেন। মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে এবং নিজে উদাহরণ স্থাপন করে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, পরিবেশ শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি সবার দায়িত্ব।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদেও তার পরিবেশ ও জলবায়ু উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। শহরের বায়ুদূষণ কমাতে তিনি টু-স্ট্রোক পেট্রোল ও ডিজেলচালিত থ্রি-হুইলার বন্ধ করেন এবং সিএনজিচালিত যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে পাতলা পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয় এবং কাগজ ও তুলার ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহ দিতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা হয়।
খালেদা জিয়া পরিবেশ ও সমাজকে সমন্বিতভাবে দেখতেন। তিনি শুধু আইন প্রণয়নেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, পরিবার, সন্তান এবং সাধারণ মানুষ যেন এসব বিষয় উপলব্ধি করতে পারে।
সরকারি দপ্তর কিংবা বাসভবনে, আনুষ্ঠানিক বৈঠক কিংবা ব্যস্ত সময়ের মাঝেও তিনি পরিবেশ সচেতনতা, বন সংরক্ষণ ও সামাজিক অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগে সময় দিতেন। এতে পরিবার ও সন্তানদের যুক্ত করার প্রচেষ্টাও ছিল, যাতে পরিবেশ শিক্ষা পরিবারকেন্দ্রিকভাবে বিস্তৃত হয়।
নদী দূষণ মোকাবিলায় তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল হাজারীবাগ ট্যানারি স্থানান্তর। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল না; বরং তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে নদী রক্ষা মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। শহর ও গ্রামে বৃক্ষরোপণ, বিদ্যালয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বন সংরক্ষণ—সবই তার পরিবেশবান্ধব কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল।
তিনি কেবল নীতিগত উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি; মানুষকেও এই আন্দোলনের অংশ করতে চেয়েছেন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবামূলক সংগঠন এবং স্কুল-কলেজের সঙ্গে কাজ করে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো ছিল তার নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তিনি চাইতেন মানুষ নিজে দেখুক, শিখুক এবং পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিক।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর বেগম খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তবে তার পরিবেশ ও জলবায়ু নেতৃত্ব বাংলাদেশের পরিবেশনীতি, সামাজিক সচেতনতা এবং প্রাকৃতিক সংরক্ষণে চিরস্থায়ীভাবে বিদ্যমান। শুধু আইন ও নীতিমালাই নয়— মানুষকে সম্পৃক্ত করে, পরিবারকে শিক্ষিত করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যে বার্তা তিনি রেখে গেছেন, তা আজও প্রতিটি বৃক্ষ, নদী, শহর ও গ্রামে প্রতিফলিত।
খালেদা জিয়ার জীবন আমাদের দেখিয়েছে— একজন নেতা হতে হলে শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই নয়, প্রয়োজন মানবিক সংবেদনশীলতা, পরিবেশ সচেতনতা এবং মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। এই শিক্ষা আজও আমাদের জন্য প্রেরণা, যেন বাংলাদেশ আরও সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।





























