• ১লা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ রবিবার সকাল ৭:০৭
S M Tajul Islam মে ৩০, ২০২৫

‘রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইতিহাসের এক বরপুত্র’: বাছির জামাল

নিজস্ব প্রতিবেদক: জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরই পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করার ব্যবস্থা করে বিএনপি। কোনো এক বছর এমনি এক ক্রোড়পত্রে শহীদ জিয়ার জীবনের ওপর লিখতে বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট লেখককে বিএনপির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল। লেখকের রাজধানীর বাসায় যখন এ অনুরোধ জানানো হয়, তখন নিবন্ধকারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুরোধের জবাবে অল্প সময়ে লেখার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলেও ওই লেখক জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যে কয়েকটি কথা বলেছিলেন, তা মূল্যায়নের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। লেখক বলেছিলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই সমরবিদ থেকে সফল রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন—এমন উদাহরণ কম নয়। রাষ্ট্রচালনার ইতিহাসে তাদের অবদান স্থায়ী আসন পেয়েছে। এসব রাষ্ট্রনায়ককে পৃথিবীর মানুষ সম্মানের চোখে দেখে। কিন্তু বাংলাদেশে এ চিত্র উল্টো। বোধকরি সেনাশাসকদের অধীনে একীভূত পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না বলে, বাংলাদেশ আমলে সেনানায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়া জিয়াউর রহমানের অবদান অনেকে স্বীকারই করতে চান না। অন্য কোনো দেশে জন্ম হলে জিয়াউর রহমান চির অমর হয়ে থাকতেন।

লেখক হুবহু না হলেও এমন ধরনেরই কথা জিয়াউর রহমানের ব্যাপারে বলেছিলেন বলে মনে হয়। আসলে আমরা যখন বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন দেখি এমন অনেক সেনানায়ককে যারা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও সমানভাবে সফল। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নামই সবার আগে আসে। তিনি একাধারে ফ্রান্সের সম্রাট ও ইতালির রাজা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি সারা বিশ্বে সর্বকালের এক অনন্য সেনানায়ক হিসেবেও পরিগণিত। সেনাবাহিনীতে তার উদ্ভাবনসমূহ বর্তমানে প্রায় সব সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নেপোলিয়ন কোড প্রতিষ্ঠাও তার অন্যতম সেরাকীর্তি। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোক হিসেবে তার রাজনৈতিক অবদানকে কেউ অস্বীকার করেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকায় বিপ্লবের সময়কার কন্টিনেন্টাল আর্মির কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। তিনি জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনাও করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল একজন প্রথিতযশা সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। তার নেতৃত্বেই ব্রিটিশ জাতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবুরও সেনাপতি ছিলেন। তার অসাধারণ সমরকুশলতায় ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন হয় ১৫২৬ সালে। আরও আগে গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসও (৪৯৫-৪২৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) গ্রিক ইতিহাসের আলোচিত যুদ্ধ পেলেপসেনিয়ান যুদ্ধসহ নানা যুদ্ধে অ্যাথেনিয়ান বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। একই সঙ্গে তার সময়েই গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল। অন্য গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক সলোনও (৬৩৮-৫৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সালামাইস বদ্বীপ দখল নিয়ে যখন অ্যাথেন্স ও ম্যাগারা নগর রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন তিনি ওই যুদ্ধে অ্যাথেনিয়ান সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রও পরিচালনা করেছিলেন। ইতিহাসের এমন আরও ভূরিভূরি সেনানায়কের উদাহরণ দেওয়া যাবে, যারা একাধারে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কোনোটাই তাদের সফলতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও ইতিহাসের এমনই এক বরপুত্র। কিন্তু সামরিক জীবনের প্রতি বাঙালি জাতির এক ধরনের উন্নাসিকতা এবং অধিকন্তু রাজনৈতিক দলাদলির কারণে জিয়াউর রহমানের অনন্য অবদানগুলোকে এখানকার রাজনৈতিক সমাজ ও সিভিল সমাজ পাশ কাটিয়ে যান কিংবা অস্বীকার করেন। এ কথা সত্য যে, জিয়াউর রহমানের অবদান কেউ স্বীকার করুক আর না করুক কিংবা খাটো করে দেখুক আর না দেখুক, ইতিহাস কিন্তু জিয়াউর রহমানকে এরই মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। আর জিয়াকে নিয়ে যারা উপহাস করছেন, তাদের স্থানও ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। ইতিহাস বড় নির্মম। ইতিহাসের বিচার থেকে কেউই রক্ষা পাবে না।

মুক্তিযুদ্ধ সফল না হলে তার মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। তিনি তার পরিণতির কথা চিন্তা করেই ইতিহাস পাল্টানোর মতো অমোঘ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা: ২০৮)। গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, “কিন্তু তাঁর (জিয়া) সকল ব্যর্থতাকে মলিন করে দেয়, তাঁর অসামান্য একটি অবদান। সে হলো : মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা।” (গোলাম মুরশিদ, ওই, পৃষ্ঠা : ২৩৬)।

তিনি বিদ্রোহ করে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার সৌধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানকে অভূতপূর্ব এই দুটি কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান করে দেয় এবং একই সঙ্গে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। এটা কে না জানে যে, তার হাত ধরেই বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পরিধি বৃদ্ধি করে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইতিহাসে জিয়াউর রহমানই এক স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিত্ব, যিনি জাতির মুক্তি ও জাতি গঠনের দুটি পর্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বরং বলা চলে বাংলাদেশি জাতি গঠনের কাজটি তার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে।

জিয়াউর রহমানকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট, যা সেই স্বাধীনতার পর থেকেই চলে এসেছে, তার কারণ কিন্তু সাধারণভাবে জনগণ নয়। বরং পাশ্চাত্য শিক্ষিত এলিটদের মধ্যকার তীব্র ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দলাদলিই দেশের এ সংকটের জন্য দায়ী। মনিরুজ্জামান বাংলাদেশি রাজনীতির একজন বিদগ্ধ পর্যবেক্ষক মারকাস ফ্রান্ডার (Marcus Franda) উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বলেন, ভারতের মতো বাংলাদেশে ভাষাগত, ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত কোনো দলাদলি নেই। তবে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বদেশ প্রত্যাগত, পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ, মুসলিম মৌলবাদী ও উদারতাবাদী, বামপন্থি ও ডানপন্থিদের মধ্যে ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তিনি বলেন, এই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বই স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের জীবনীশক্তিকে দুর্বল করে ফেলে এবং জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের আগে ও পরে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।

এ প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে সফল হতে হলে একজন রাজনৈতিক নেতাকে এসব দ্বন্দ্বকে কীভাবে বশে আনতে হয় তা জানতে হবে। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিভার এখানেই পরিচয় পাওয়া যায় যে, তিনি এসব দ্বন্দ্ব সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন এবং একে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে তা জানতেন। জিয়াউর রহমান তার ‘ভারসাম্যের রাজনীতির’ মাধ্যমে এসব মোকাবিলা করেছিলেন। (Talukder Maniruzzaman, Politics and Security of Bangladesh, P-৬৬-৬৭)।

মনিরুজ্জামান বলেন, “‘যুবক জেনারেল জিয়া’ (১৯৭৫ সালে তার বয়স ছিল ৪০) নিজেকে অন্তর্জ্ঞানসম্পন্ন, স্বাপ্নিক ও উদ্যোমী নেতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন।” তিনি আরও বলেন, “তিনি (জিয়া) সেনাবাহিনীর উপর রাজনীতির প্রাধান্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি আরও দেখতে পেলেন, একটি সুস্থির বেসামরিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অপেশাদার, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং বিভক্ত সেনাবাহিনী। তারপর জিয়া বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সেনাবাহিনীকে একটি সুশৃঙ্খল ও গর্বিত বাহিনী হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পুনর্গঠন করার কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তা মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেন। সর্বোপরি তিনি শেখ মুজিব প্রবর্তিত ভাষাভিত্তিক-রাষ্ট্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক-রাষ্ট্রিক-ইসলাম ধর্ম সম্মত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাবের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়াটা জরুরি। তিনি বাস্তববাদী অর্থনৈতিক কর্মসূচি যেমন ‘উৎপাদনের রাজনীতি’ গ্রহণ করে অপর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন, অশিক্ষা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান করেন। তিনি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে একই স্থানে জড়ো করার উদ্দেশে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। পরে এটিকেই একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করেন। এই দলের নাম বিএনপি। পরে তিনি নির্বাচনী রাজনীতি পুনরুদ্ধার করেন” (Talukder Maniruzzaman, Politics and Security of Bangladesh)।

লেখক: বাছির জামাল
সাংবাদিক
বিএফইউজের সিনিয়র সহকারী মহাসচিব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *