• ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সোমবার বিকাল ৫:৪২
S M Tajul Islam ডিসেম্বর ৮, ২০২৫

যে কারণে সাংবাদিক শওকত মাহমুদ গ্রেপ্তার, তালিকায় আরো কয়েকজন

ঢাকা : বিএনপির সাবেক নেতা, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জনতা পার্টির মহাসচিব শওকত মাহমুদকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। রোববার (৭ই ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবিপ্রধান শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ প্রসঙ্গে বলেন, গত ২০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। সেই মামলায় শওকত মাহমুদকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

একই অভিযোগে শওকত মাহমুদসহ মোট দুজন সাংবাদিক এই পর্যন্ত গ্রেপ্তার হলেন। এনায়েত করিমের সঙ্গে মিলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করার গুরুতর অভিযোগ আছে শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।

এর আগে গত অক্টোবরে সাংবাদিক আজহার আলী সরকারকে ঢাকার রমনা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্তসংশ্লিষ্টেরা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে ‘উৎখাতের’ ষড়যন্ত্রের অভিযোগে করা মামলায় এনায়েত করিম চৌধুরী ওরফে মাসুদ করিমের সহযোগী ছিলেন আজহার।

আজহার আলী সরকার একসময় সাংবাদিকতা করতেন। তিনি আমাদের সময় পত্রিকায় কাজ করেছেন। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে জানিয়েছে তার পরিবার।

রোববার শওকত মাহমুদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাতীয় ও সারাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের কোনো কোনো সাংবাদিক ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বিষয়টিকে দেখছেন, জ্যেষ্ঠ একজন সাংবাদিক নেতাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকারের ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন’ হিসেবে। তবে এই গ্রেপ্তারের সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মূলধারার সাংবাদিকদের অভিমত।

বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একটি সূত্র সুখবর জানায়, ‘প্রতারক’ এনায়েত করিম ও শওকত মাহমুদের প্রতারণার ‘ফাঁদে’ পা না দিতে দলটির শীর্ষ কয়েক নেতাকে ২০২১ সালেই মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়। বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাকে শওকত মাহমুদ ও এনায়েত করিমের সঙ্গে বিদেশে বৈঠক করায় দলের পক্ষে শোকজও করা হয় ওই বছর।

গোয়েন্দা সূত্র সুখবর জানিয়েছে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপিপন্থী সাংবাদিক শওকত মাহমুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে এনায়েত করিম প্রতারণা চালিয়ে গেছেন। এরপর থেকে তার সঙ্গে এনায়েতের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। নিজেকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে প্রতারণা করতেন তিনি। এর আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলেও (২০০১-০৬ সাল) একবার এনায়েতকে প্রতারণার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

অনুসন্ধান বলছে, গত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে এনায়েত বিএনপিসহ একাধিক দলের বিভিন্ন নেতাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তখন তিনি তাদের কাছে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী সংস্থার লোক বলে পরিচয় দেন। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে এনায়েত ব্যাংকক ও নেপালে একাধিক বৈঠকও করেন।

এসব বৈঠকের সমন্বয়ক ছিলেন শওকত মাহমুদ। তার ‘ফাঁদে পা দিয়ে’ বিএনপিসহ কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন সেসব বৈঠকে। বৈঠকে উপস্থিত থাকায় বিএনপি শওকত মাহমুদ ও দলটির আরেক শীর্ষ নেতাকে কারণ দর্শানোর চিঠিও দেয়। এ বিষয়ে ২০২১ সালের ২১শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ব্যাংককের বৈঠকে চাকরিচ্যুত এবং অবসরপ্রাপ্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে এনায়েতের গাড়ি চালক ও দেহরক্ষী হিসেবে পরিচয় দেওয়া এক ডিআইজিও ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, এনায়েত করিম ২০ বছরের বেশি সময় ধরে একটি প্রভাবশালী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান পরিচয় দিয়ে বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর স্বপ্ন দেখিয়ে, কখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল ডিনারে আমন্ত্রণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নেন।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও অনেক নেতার কাছ থেকে অর্থ নেন এনায়েত। ২০১৮ সালের পর বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তিনি প্রতারণা চালিয়ে গেছেন।

এনায়েতের প্রতারণার বিষয়ে একটি সূত্র জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত একজনকে বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে কয়েকজন র‍্যাব কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসে। তখনও তিনি সরকার পরিবর্তনের আভাস দিয়ে কারও কারও কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এগুলোর সঙ্গে শওকত মাহমুদ জড়িত বলেও অভিযোগ আছে।

চলতি বছর বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা দাবি করা এনায়েত করিম ওরফে মাসুদ করিম চৌধুরীকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আনতে যান পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। এরপর এনায়েতের নিরাপত্তায় নিজের দেহরক্ষীকে (একজন পুলিশ সদস্য) নিয়োজিত করেছিলেন পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা।

গ্রেপ্তারের সময় ওই দেহরক্ষী এনায়েত করিমের সঙ্গেই ছিলেন। দেহরক্ষীকে পরে বরখাস্ত করা হয়েছে। ডিআইজির বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

চলতি বছরের ৬ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসার পর এনায়েত দুদিন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ছিলেন। ওই হোটেল বুকিং ও তার ভাড়া পরিশোধ করেছিলেন জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী অংশের মহাসচিব পরিচয় দেওয়া কাজী মামুনুর রশিদ। গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত এসব তথ্য দেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম তখন জানান, এনায়েত করিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বিষয়ে জানা গেছে। তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে ওই সব সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

গত ২০শে সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১০টার দিকে মিন্টো রোড এলাকা থেকে এনায়েতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই সময় প্রাডো গাড়িতে করে ‘সন্দেহজনকভাবে’ ঘুরছিলেন তিনি। পুলিশের সন্দেহ হলে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঘোরাঘুরির কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তখন পুলিশ তাকে হেফাজতে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে রমনা মডেল থানায় মামলা করে।

ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছিল, এনায়েত নিজেকে মাসুদ করিম নামে পরিচয় দেন। তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রধান বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এ পরিচয়ে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখান।

২০১৮ সালের ভোটের আগেও তিনি একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দেশের বাইরে বৈঠক করেন। গত ৬ই সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন।

তার বিষয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়েছে, আসামি এনায়েত একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অস্থিতিশীল’ করার মিশন নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি বর্তমান সরকার ‘উৎখাতের’ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত।

এদিকে গত এপ্রিলে জনতা পার্টি নামে রাজনৈতিক দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দলটির চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আর মহাসচিব শওকত মাহমুদ। একসময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন শওকত মাহমুদ। ২০২৩ সালের ২১শে মার্চ বিএনপির সব পর্যায়ের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল এনায়েত করিমের সঙ্গে তার বিদেশে বৈঠক করা ও তার প্রতারণার সহযোগী হওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *