• ২২শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার বিকাল ৫:০০
S M Tajul Islam আগস্ট ২২, ২০২৫

দীর্ঘদিনের লুটপাট, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মূলধন সংরক্ষণে খারাপ অবস্থায় বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘদিনের লুটপাট, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে এখন ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হলেও তার বেশিরভাগই ফেরত আসেনি। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার দেশের ব্যাংক খাতকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। সবমিলিয়ে যার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন মূলধন সংরক্ষণের দিক থেকে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৪ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ২০২৩-এর তুলনায় ২০২৪ সালে মূলধন পর্যাপ্ততার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালে যেখানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, সেখানে ২০২৪ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে। আর মূলধন পর্যাপ্ততা হারের এই অবনমনকে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

যদিও তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। শ্রীলঙ্কা একসময় অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের কবলে পড়লেও ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যাংক খাতে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করেছে, যে অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। পাকিস্তান ২০ দশমিক ৬ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করে শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে এবং ভারত ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করে রয়েছে তৃতীয় স্থানে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের হার দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করেছিল, তবে ২০২২ সালে তা কিছুটা বেড়ে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশে পৌঁছেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে এটি ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ব্যাংক খাতের শোচনীয় অবস্থার প্রমাণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে ঋণের বড় অংশ খেলাপিদের কাছে আটকে থাকার কারণে মূলধন সংরক্ষণের হার এত কমে গেছে। ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে অর্থ ফেরত পাচ্ছে না, ফলে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, যত বেশি খেলাপি ঋণ, তত কম ব্যাংকের মূলধন, আর এর ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বা পুনর্বিনিয়োগের সক্ষমতাও কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের সিএআর (মূলধন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের অনুপাত) হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারত তুলনামূলকভাবে উন্নত অবস্থানে রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দেয়। তবে ব্যাংক খাতের এ দুরবস্থার কারণে শুধু ব্যাংকগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং এর প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়ছে। ঋণের ফেরত না আসা এবং ব্যাংকগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত আর্থিক অবস্থা ব্যবসায়িক পরিবেশকে বিপর্যস্ত করতে পারে, যার ফলে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা আরও দুর্বল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক খাতে পুনর্গঠন ও সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। ব্যাংকগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনতে এবং খেলাপি ঋণ কমাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে এ খাতের সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণ বলছে, ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ২০২৪ সালে দেশটির ব্যাংক খাত মূলধন সংরক্ষণ করেছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগের বছর ২০২৩ সালে দেশটির ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এর আগের বছর ২০২২ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। ২০২৪ সালে দেশটির ব্যাংক খাত মূলধন সংরক্ষণ করেছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এর আগের বছর ২০২৩ সালে দেশটির ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। ২০২৪ সালে দেশটির ব্যাংক খাত মূলধন সংরক্ষণ করেছে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে ভারতের মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ১৬ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সংকট অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ। মূলধন সংরক্ষণে এত বড় ঘাটতি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দুর্নীতি ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় তদারকির অভাবই এ অবস্থার জন্য দায়ী। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর উন্নতি দেখে বাংলাদেশকে দ্রুত ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ও স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। না হলে এ সংকট দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *