
জুলাই গণহত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনার বিচার শুরু মে মাসে
ঢাকা : সুপিরিয়র কমান্ড হিসেবে শেখ হাসিনাই জুলাই গণহত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন। তার বিচার হবে সুপিরিয়র কমান্ড হিসেবে। মে মাসে এ বিচার শুরুর প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়াও সুপিরিয়র কমান্ডের আসামি হিসেবে রয়েছেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক, পালিয়ে যাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ উচ্চপদস্থরা। গণহত্যার সুপিরিয়র কমান্ডের জন্য দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক চার্জশিট এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ট্রাইব্যুনালে সুপিরিয়র কমান্ডের বিচারের জন্য চার্জশিট উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রসিকিউশন। সুপিরিয়র কমান্ডের পাশাপাশি আরো দুটি চার্জশিট দাখিলের লক্ষ্যে রাতদিন কাজ করছে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা। এরই মধ্যে আট ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে গণহত্যায় দায়ী করে একটি চার্জশিট গত সপ্তাহে দাখিল করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। ওই চার্জশিটের আলোকে চার্জ গঠনের জন্য শিগগিরই আবেদন জানানো হবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন সূত্র।
ট্রাইব্যুনালসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী মে মাসের প্রথমার্ধেই একাধিক মামলার বিচার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চার্জশিট দাখিলের পরপরই ট্রাইব্যুনাল চার্জ গঠনে সন্তুষ্ট হলে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। উপস্থাপন করা অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল চার্জ গঠনের আদেশ দিলেই আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারের জন্য আনুষ্ঠানিক কয়েকটি ধাপের মধ্যে রয়েছে ট্রাইব্যুনালে চার্জশিট উপস্থাপন ও চার্জ গঠনের জন্য শুনানি।
উপস্থাপিত চার্জশিটের ওপর শুনানিতে ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হলে চার্জ গঠন ও বিচার শুরুর নির্দেশ দেবে। এরপরই শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণের পালা। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করে ঘটনার সত্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। তারপর প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবী তাদের নিজ নিজ দাবির পক্ষে আইন, প্রসিডিংস ও যুক্তি উপস্থাপনের পর বিচারকরা রায়ের দিন ধার্য করেন। ১৫ বছরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার এখনো প্রথম ধাপে রয়ে গেছে। যদিও প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের আগেই একাধিক ঘটনার বিচার নিষ্পত্তি করতে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। সব ঘটনায় শেখ হাসিনাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার বিচার হবে সুপিরিয়র কমান্ড হিসেবে চার্জশিটের আওতায়। তার সঙ্গে আসামি হিসেবে থাকবেন আসাদুজ্জামান খান কামাল, শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমদ সিদ্দিক, পুলিশের আইজি ও র্যাবের ডিজি।
সুপিরিয়র কমান্ড হিসেবে শেখ হাসিনাই গণহত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন এমন তথ্যপ্রমাণ প্রসিকিউশন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। শেখ হাসিনার নির্দেশনার অডিও-ভিডিওর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে রাজসাক্ষী হওয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত সংস্থার একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব ভিডিও ফুটেজ বড়পর্দায় দেখে গুলিবর্ষণকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেওয়ার সময় অনেকেই তাদের তোলা ভিডিও ফুটেজ সরবরাহ করছেন তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমকে। কোনো কোনো ঘটনাস্থলে তদন্ত সংস্থার সঙ্গে প্রসিকিউশনের একটি টিমও যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে। এ ছাড়া ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের এনেও জিজ্ঞাসাবাদ করে গুলিবর্ষণকারীর নাম ও পরিচয় শনাক্ত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
এদিকে ১৫ বছরের দুঃশাসনে শেখ হাসিনা ও তারেক সিদ্দিকের হুকুম তামিল করে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ রাজনৈতিক নেতাদের গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার নায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান। তার বিরুদ্ধেও চার্জশিট প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ এরই মধ্যে প্রসিকিউশন টিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। এ সংক্রান্ত অন্তত দুটি ঘটনায় শেখ হাসিনা এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের পক্ষ থেকে।
গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার শাসন আমলজুড়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ঢেলে সাজানো হয় প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা।
শেখ হাসিনার শাসন আমলজুড়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও ভিন্নমত পোষণকারীদের গুম করা হতো। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে গুম করার পর চিরদিনের জন্য হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত কমিশনের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গুমের শিকার চার শতাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আর কোনোদিন ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। এসব পরিবার গুম হওয়া আপনজনকে ফেরত পাওয়ার প্রত্যাশার পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামও করছে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাক এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যা, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের পর প্রতিবাদী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা, একই বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশে চালানো গণহত্যাসহ বেশ কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত বছরের ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে ৩৬ দিনে জাতিসংঘ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী এক হাজার ৪০০ প্রতিবাদী মানুষকে হত্যা করা হয়। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী গুন্ডাদের গুলিতে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে আহত হন প্রায় ৩০ হাজার। আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন এবং চোখ হারিয়ে অন্ধ হয়েছেন অনেকে। গণহত্যায় নিহতদের পরিবার, আহত ও পঙ্গু হওয়া ও চোখ হারানো মানুষজন তাকিয়ে আছে ট্রাইব্যুনালের বিচারের দিকে। তাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেওয়া মানুষজনও দ্রুততম সময়ে বিচারের প্রত্যাশা করছেন।
এ বিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার টিম রাতদিন নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তদন্ত টিমের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য তিনি নিজেও বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানান তিনি।
আগামী মাসের মধ্যেই অন্তত তিনটি মামলার বিচার শুরু হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, সুপিরিয়র কমান্ডে যারা ছিলেন তাদের বিচার আগে করার জন্য চেষ্টা চলছে। তারপর ধাপে ধাপে অন্যদের বিচার হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে। এতে দুই হাজারের বেশি লোক শহীদ হয়েছেন। ২৫ থেকে ৫০ হাজারের মতো লোক আহত হয়েছেন।
এখানে যারা অপরাধগুলো সংঘটিত করেছে, তাদের সংখ্যাও হাজার হাজার। এই বিবেচনায় মামলাগুলোর তদন্ত অনেক সময়সাপেক্ষ। কিন্তু তার মধ্যে যারা সুপিরিয়র কমান্ডার ছিলেন, অগ্রাধিকারভিত্তিতে তাদের মামলাগুলো এগিয়ে নিয়ে এসেছি। এখন চার্জশিট দাখিলের প্রস্তুতি চলছে। চার্জশিটে কোর্ট সন্তুষ্ট হলে চার্জ গঠনের পরই বিচার শুরু হয়ে যাবে। এতে আগামী মাসেই শেখ হাসিনার বিচারকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে পারে।