কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও প্রশিক্ষক সংকট
ল্যাবে কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার সবই আছে— আছে উন্নতমানের প্রজেক্টরও। সব কিছু থাকলেও নেই শুধু দক্ষ প্রশিক্ষক। কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক থাকলেও তাদের নেই পর্যাপ্ত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান। অনেকে আবার বৃদ্ধ বয়সে কয়েক দিনের আইটি প্রশিক্ষণ নিয়ে বনে গেছেন আইটি প্রশিক্ষক। কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার অথবা সফটওয়্যার সংক্রান্ত জ্ঞান না থাকলেও এসব প্রশিক্ষক দিয়েই চলছে দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব।
ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরদিকে নষ্ট হচ্ছে সরকারের কোটি টাকার সরঞ্জাম। ব্যাহত হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার প্রধান উদ্দেশ্য। প্রোগ্রামিং, কোডিং, রোবটিক্স বা ফ্রিল্যান্সিং তো দূরের কথা, শুধু ডিভাইস বন্ধ বা সচল করা অথবা ক্ষেত্রবিশেষ কিছু স্থিরচিত্র বা ভিডিও ফুটেজ দেখানোতেই সীমাবদ্ধ থাকছেন এ নামসর্বস্ব প্রশিক্ষকরা।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আবার ন্যূনতম এ সুবিধাটুকুও থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে দিনের পর দিন এসব ল্যাবে নিয়ম করে ডিভাইসগুলো চার্জ দেয়া আর ধুলোবালি পরিষ্কার করার মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে। অনুসন্ধান বলছে, ইসলাম শিক্ষা অথবা দর্শনের শিক্ষকদের কম্পিউটার শিক্ষকের পদে চাকরি দেয়া হয়েছে। অনেকে আবার বাংলা বা ইতিহাস পড়েও নিয়োগ পেয়েছেন কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না নির্দেশনা, নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এসব সরঞ্জামের যথার্থ ব্যবহার। দক্ষ প্রশিক্ষকের এ সংকট শহর অপেক্ষা গ্রামে আরও বেশি।
দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে সরকার সারা দেশে আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের আইসিটি বিষয়ক শিক্ষাদানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করে। পরবর্তীতে ২০২০-২৩ মেয়াদে সারা দেশে আরও পাঁচ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ৩০০ স্কুল অব ফিউচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যা ২৮ জুলাই ২০২০ একনেকে অনুমোদিত হয়েছিল।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আইসিটি ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তোলা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়ায় কতটা দক্ষ প্রশিক্ষক নিশ্চিত করা যাচ্ছে এমন প্রশ্ন অভিভাবকদের।
সরেজমিন বিভিন্ন ল্যাব পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রতিটি ল্যাবে ১৭টি ল্যাপটপ, একটি এলইডি স্মার্ট টিভি, ওয়েব ক্যামেরা, প্রিন্টার, ল্যান কানেকশন সেটিং মাল্টিপ্লাগ, রাউটার, স্ক্যানারসহ মোট ২৩টি আইসিটি সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসবাবপত্র সরবরাহ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
এসব সরঞ্জাম সংরক্ষণ ও মেরামতেও যথেষ্ট ঘাটতি দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের। ল্যাব থাকা সত্ত্বেও দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে প্রতিষ্ঠানের অনলাইন কিংবা কম্পিউটারের কাজও বাইরে কম্পিউটারের দোকান থেকে করেছেন এমন প্রমাণও মিলেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আবার ল্যাপটপ বাড়িতে নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন এমন অভিযোগও এসেছে কিছু প্রতিষ্ঠানে।
কম্পিউটার ল্যাব পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী, ল্যাবগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি-না তা তদারকি করা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার কথা রয়েছে জেলা ও উপজেলা আইসিটি বিষয়ক কমিটির। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ল্যাবগুলোর তদারকিতেও ঘাটতি দেখা গেছে। এছাড়া ল্যাব রেনোভেশন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সব শর্ত মেনে ল্যাব স্থাপনেও অনিয়মের অভিযোগ বিস্তৃত।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে ল্যাপটপ, ডেস্কটপগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহূত না হওয়ায় এগুলোর ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়া, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ইন্টারনেটের গতির সীমাবদ্ধতা, যন্ত্রপাতিগুলো যথাসময়ে সার্ভিসিং না করাসহ বিভিন্ন কারণে ল্যাবের প্রধান উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের এমন পরিকল্পনায় আগে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিত করে তারপর ইক্যুইপমেন্ট নিশ্চিত করা যেতে পারে। এতে করে একাধারে ল্যাবের প্রধান উদ্দেশ্য পূরণের পাশাপাশি এসকল সরঞ্জামও সংরক্ষিত করা সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে প্রোগ্রামিং, রোবটিক্স, ফ্রিল্যান্সিং, কোডিং, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিটি শিক্ষক নিয়োগসহ বিদ্যমান আইসিটি শিক্ষকদের পাশাপাশি অন্য বিষয়ের শিক্ষকদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
এছাড়া ল্যাবগুলোয় পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটারবিষয়ক ব্যবহারিক ক্লাস নিশ্চিত করা। একই সাথে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও আগ্রহী যুবক ও তরুণদের শিক্ষার জন্য ওই ল্যাবগুলো উন্মুক্ত করা যেতে পারে। এর বাইরে বিদ্যালয়গুলোয় প্রোগ্রামিং ও রোবটিক্স ক্লাব গঠন করে ওই ক্লাবগুলোর মাধ্যমে আন্তঃস্কুল ও আন্তঃউপজেলা প্রোগ্রামিং, রোবটিক্স ও কোডিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা গেলে শিক্ষার্থীরাও এসব সরঞ্জাম ব্যবহারে আগ্রহী হবে। তবে সব কিছুর আগে দক্ষ প্রশিক্ষক নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
এ সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, নানা জটিলতায় ল্যাব এসিস্ট্যান্টও নিয়োগ দেয়া হয়নি। যে কারণে ল্যাবের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা দুরূহ। এ ছাড়া উপর মহল থেকে প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব ও দক্ষ প্রশিক্ষক নিয়োগ না দেয়ায় ল্যাবগুলোর এই বেহাল দশা। দেখা গেছে, শিক্ষার্থী আছে ১০০ থেকে ২০০ জন। এক সাথে এসব শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক ক্লাস নেয়া কষ্টকর। পৃথকভাবেও সম্ভব হয় না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে। দক্ষ প্রশিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরাও ল্যাবের প্রতি সহজাত আগ্রহ হারাচ্ছে।
জানতে চাইলে একাধিক শিক্ষার্থীরা বলেন, একদিনও ল্যাবে ব্যবহারিক ক্লাস হয়নি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও একই রকম। ল্যাবে কি শেখায় তা জানা নেই। তা ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে শুধু কম্পিউটার বন্ধ বা সচল করাসহ স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়।
এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব সরকারের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। কোভিডের সময় আমরা ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এ সুযোগ সবার কাছে পৌঁছাতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, শিক্ষকদের সক্ষমতা এবং একই সাথে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা প্রয়োজন।
দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ল্যাবগুলো প্রস্তুত হয়েছে, পর্যাপ্ত সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও সেখানে কাজ করতে প্রস্তুত কিন্তু এক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষকের সংকট প্রবল। দক্ষ শিক্ষকের সংকট থাকার কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাবগুলো বন্ধ করে রাখারও উদাহরণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব তুলেছি। ভালো উদ্যোগগুলো সামনে এগিয়ে নিতে হলে যারা এসবের চালিকাশক্তি তাদের (বিশেষ করে ল্যাব পরিচালনায় নিয়োজিত শিক্ষক) সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। শিক্ষকদের এ সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ প্রয়োজন, প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যেহেতু ল্যাব প্রতিষ্ঠায় সরকারের বড় বিনিয়োগ রয়েছে সুতরাং এই মুহূর্তে এই বিনিয়োগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে কি-না এসব তদারকিতে শিক্ষা প্রশাসনকে তৎপর থাকতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায়, গ্রামের একটি বিদ্যালয়ের সমস্যা ঢাকাতে ফাইল আকারে আসতেই অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। এরপর এ ফাইল আবার বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে সুরাহা হতেও রয়েছে নানান জটিলতা। এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে শিক্ষা প্রশাসনের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সমস্যা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী দ্রুত কার্যকরী সমাধান নিতে হবে। তবে সামগ্রিক এ প্রক্রিয়ায় মনিটরিং জোরদার করতে হবে।’
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রে ল্যাব পরিচালনায় দর্শন বা গণিতের শিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণ দিলে তা ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না।
রোবটিক্স, ফ্রিলান্সিং, কোডিং বা অটোমোশনের মতো বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতে হলে অবশ্যই আইসিটি বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। দেশে অনেক আইসিটি গ্রাজুয়েট রয়েছে। সরকার চাইলে তাদের নিয়োগ দিতে পারেন। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে কোটি টাকার এসব সরঞ্জামও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়। দেশের মেডিকেল সেক্টরে তাকালে দেখা যাবে অনেক বড় বড় ল্যাব রয়েছে যেগুলোতে দক্ষ জনবলের অভাবে সচল করা সম্ভব হয় না। সুতরাং শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবগুলোতেও দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিত করতে না পারলে এমন হবে যে, রোবটিক্সের জন্য ল্যাব থাকবে; শিক্ষার্থীরাও জানবেন এটি রোবটিক্স ল্যাব। কিন্তু কোনো কাজ হবে না সেখানে।’