কমলাপুরের রেল সেবা প্রকৌশলী মোবারক চক্রের নিয়ন্ত্রণে
ঢাকা : মো. ইসমাইল হোসেনসহ তার আপন চার ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, বোন, বোনের স্বামী, ভাগ্নেসহ একই পরিবারের ৯ জন চাকরি করেন রেলের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঢাকা কার্যালয়ে। এ অফিসের প্রধান প্রকৌশলী মোবারক হোসেন। তিনিই তাদের চাকরি দিয়ে দায়িত্বে রেখেছেন নিজের অফিসে।
রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমলাপুরে প্রকৌশলী মোবারককে সবাই চেনেন পিএসসির প্রশ্নফাঁস চক্রের হোতা গাড়িচালক আবেদ আলীর লোক হিসেবে। রেলে তিনি আবেদ আলীর প্রতিনিধি হয়ে ফাঁস প্রশ্নপত্র বিক্রি করে দিতেন চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায়ও ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে প্রার্থী ছিল এই মোবারকের। তবে ওই ঘটনায় সিআইডির হাতে আবেদ আলী ও তার ছেলেসহ ১৭ জন গ্রেপ্তার হওয়ার পর ‘শিষ্য’ মোবারক কিছুদিন চুপ থাকেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফেরেন আগের রূপে।
রেল সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রেলের বিদ্যুৎ অফিসের এই প্রকৌশলী সরকারি প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন নিয়োগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সরকার পরিবর্তন হলেও নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। এর মধ্যেই ঘটিয়ে ফেলেন আরও বড় অঘটন। সম্প্রতি কমলাপুর স্টেশনের স্ক্রিনে ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ লেখা ভেসে ওঠার পেছনেও এই প্রকৌশলীকে অভিযুক্ত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ওই কাণ্ডের পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করা হলেও তার প্রভাব কমেনি। তিনি নিয়মিত অফিসে আসেন, অনুগতদের নিয়ে বৈঠকও করেন।
রেলওয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সূত্র জানায়, প্রকৌশলী মোবারক রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঢাকা অফিসে ২০০৬ সালে যোগ দেন। তার অফিসের অধীনেই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে ঢাকা-জয়দেবপুর স্টেশন হয়ে ভৈরব-নারায়ণগঞ্জ এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত রেল স্থাপনায় বৈদ্যুতিক কার্যক্রম চলে। সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী তার পদ বদলিজনিত হলেও চাকরি জীবনের ১৮ বছরের ১৬ বছর ধরেই ঢাকা অফিসে পদ ‘দখল’ করে আছেন তিনি। মাঝে দুই বছর চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেন।
রেলের বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকৌশলী মোবারক নিজের সব অপকর্ম জায়েজ করতেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নেতা পরিচয়ে। তিনি ২০১৮ সালে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদও জোর করে দখলে নিয়েছিলেন। ওই পদের নেতা হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি তুলে তা দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি।
রেল বিভাগের অন্য এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদেই রেল মন্ত্রণালয়ে যিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন, মোবারক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী নেতা পরিচয়ে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন পুরো বিভাগে। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও পাত্তা দিতেন না।
রেলের বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে টাকা নেন তিনি: সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং ভাঙ্গা পর্যন্ত সব রেল স্থাপনার বিদ্যুৎ সংযোগ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রকৌশলী মোবারকের। নিয়োগ বাণিজ্যের বাইরে এই বিদ্যুৎ সংযোগ তার অবৈধ টাকা আয়ের বড় উৎস। রেল স্থাপনা থেকে রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বাজার, দোকানপাট ও বস্তিগুলোতে তিনি অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেন। এ ছাড়া রাজধানীর তেজগাঁও কলোনি, কমলাপুর ও নারায়ণগঞ্জ কলোনিতে তার মাধ্যমে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। এরপর বাতি ও ফ্যান হিসেবে মাসিক টাকা তোলেন। এজন্য তার নিজস্ব লাইনম্যান রয়েছে।
রেলওয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মোবারক অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে মাসে অন্তত ৫ লাখ টাকা তোলেন। লাইনম্যানরা এসব টাকা তুলে তাকে দেন। সেই টাকা তিনি রেলের আরও কয়েক জায়গায় বণ্টন করেন। তবে এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে রেল বিভাগ। কমলাপুর স্টেশনে স্ক্রিনে ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ কাণ্ড ঘটানোর পর তিনি সাসপেন্ড হলে এখনো অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের টাকা যায় তার পকেটে।
নিয়োগ-কেনাকাটায় মোবারক সিন্ডিকেট: রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ১৫ বছর ধরে প্রকৌশলী মোবারক রেল বিভাগে নিয়োগে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি তা ছাড়াই নিজের পছন্দ মতো নিয়োগ দিতে চাপ দিতেন ঊর্ধ্বতনদের। সে ধারাবাহিকতায় রেলের ঢাকা বিদ্যুৎ অফিসে তিনি একই পরিবারের ৯ জনকে নিয়োগ দিয়ে তার অফিসেই পদায়ন করেন। তাদের মধ্যে ইসমাইল হোসেন নামে একজনকে চাকরি দেন লাইন কাম ওয়্যারম্যান (এলসিডব্লিউ ম্যান) হিসেবে। এ ছাড়া ইসমাইলের ছোট ভাইকে একই পদে, ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে অফিস সহকারী পদে, আরও দুই ভাইয়ের একজনকে ইলেকট্রিক খালাসি পদে ও অন্যজনকে লাইন ইলেকট্রিশিয়ান পদে, ইসমাইলের চাচাতো ভাইকে লাইন কাম ওয়্যারম্যান পদে, বোনের স্বামী ও ভাগনেকে ইলেকট্রিক খালাসি পদে এবং ছোট বোনকে স্টোর খালাসি পদে চাকরি দেন প্রকৌশলী মোবারক।
সূত্র বলছে, গত ১৫ বছরে রেলের প্রতিটি নিয়োগেই প্রার্থী হিসেবে প্রকৌশলী মোবারকের লোক ছিল। তাদের অনেককে তদবির, প্রভাব বিস্তার বা আবেদ আলীর কাছ থেকে প্রশ্নপত্র কিনে চাকরি দিয়েছেন। রেল বিভাগে কর্মীদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে রেলে উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষাতেও ৩৫ জন প্রার্থী ছিল মোবারকের। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রশ্ন পেতে আবেদ আলীকে দিয়েছিলেন।
রেলের বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মোবারক তার দায়িত্ব পালনের সময়ে কেনাকাটাতেও বড় জালিয়াতি করেছেন। সবসময় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি কাজ করাতেন।
যা বললেন অভিযুক্ত প্রকৌশলী: মোবারক হোসেন দাবি করেন, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি রেলে নিয়োগের সিন্ডিকেট চালাতেন না। রেলের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায়ের বিষয়ে এই প্রকৌশলীর ভাষ্য, কেউ তার নামে এসব ছড়াতে পারে, এ ধরনের কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। কেনাকাটাতেও কোনো অনিয়ম করেননি বলে তার দাবি।
অবশ্য চাকরি জীবনের ১৮ বছরের ১৬ বছরই রেলওয়ের ঢাকা বিদ্যুৎ অফিসে ছিলেন বলে স্বীকার করলেও দাবি করেন, তিনি এখানে বিভিন্ন অফিসে ছিলেন। আর কমলাপুর স্টেশনে স্ক্রিনে ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হ্যাকাররা লিখেছে বলে তিনি দাবি করেন। এতে তার কোনো দায় নেই।