• ১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার রাত ১:৪৯
S M Tajul Islam অক্টোবর ১৫, ২০২৫

আ.লীগের সুবিধাভোগী সচিব হচ্ছেন মিসরের রাষ্ট্রদূত

ঢাকা : ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী সাবেক সচিব সেলিম উদ্দিনকে মিসরের কায়রোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে অন্তবর্তী সরকার। পররাষ্ট্র ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলে আওয়ামী আমলে সচিব হয়ে অবসরে যাওয়া এই বিতর্কিত কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগের দেওয়ার সব প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে নিজেদেরকে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার মনে করছেন বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বিসিএস ১৩ ব্যাচের এডমিন (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯৪ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন সেলিম উদ্দিন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্যারিয়ারে দ্রুত উন্নতি পেতে থাকেন সেলিম। ২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত সময়কালে ঢাকার বাইরে শুধু একটি পোস্টিং বাদে, সবসময় ঢাকাতেই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত ভোলার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন তিনি। এর বাইরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন সেলিম উদ্দিন। ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন আওয়ামী সময়ের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিতর্কিত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে।

রাষ্ট্রদূত নিয়োগের সরকারি আদেশ। ২০১২ সালের মার্চে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে আসেন বিদ্যুৎ বিভাগে। একই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষা ছুটি নিয়ে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। দেশে ফিরে আবারও বিদ্যুৎ বিভাগে যোদ দেন এবং উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আবারও বিদ্যুৎ বিভাগে ছিলেন সেলিম উদ্দিন। সেখান থেকেই হন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সচিব হিসেবে পদোন্নতির আগ পর্যন্ত ছিলেন এই পদেই। এর আগে অবশ্য যুগ্মসচিব হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণলয়ে পোস্টিং ছিল তার।

২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ছিলেন মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এরপর সচিব হন আরও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। সচিব হিসেবে পদোন্নতির ঠিক এক বছরের মাথায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান তিনি। বর্তমানে তিনি অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) উপভোগ করছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এত এত সুবিধা নেওয়া আর আকর্ষণীয় পদ পাওয়া সেলিম উদ্দিনকেই করা হচ্ছে মিসরে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সেলিম উদ্দিনের রাষ্ট্রদূত নিয়োগে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে বাংলা আউটলুককে। আফ্রিকা মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই আরব দেশটিতে সেলিম উদ্দিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছে বলেও বাংলা আউটলুককে নিশ্চিত করেছে ওই সূত্রটি।

সেলিম উদ্দিনের এই নিয়োগে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পররাষ্ট্র ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, মিসরে অতীতে কখনোই রাজনৈতিক রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেনি বাংলাদেশ। কায়রোতে পূর্বের বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিলেন পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট থেকে ১৯৯৩ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত সাত জন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মিসরে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে শুধু লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী সেনাবাহিনী থেকে এবং বাকি ছয় জনই নিয়োজিত ছিলেন সিভিল সার্ভিসে। তারা হয় ১৯৭১ এর পূর্বে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের (সিএসপি) কর্মকর্তা ছিলেন, যাদের পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) সাথে একীভূত করা হয়; অথবা বিসিএসের পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। এমনকি ১৯৯৩ সালের এপ্রিল থেকে অদ্যবধি মিসরে যারাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বা আছেন, তারা সবাই বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা। অথচ এই প্রথা ভেঙে অবসর থেকে উঠিয়ে এনে সেলিম উদ্দিনকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হচ্ছে।

এমন ঘটনায় নিজেদেরকে বৈষম্য ও বঞ্চিত মনে করছেন পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তারা; বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের স্বপ্ন থাকে ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে এসে রাষ্ট্রদূত হওয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমরা অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছি। যে পদে এতদিন শুধু পররাষ্ট্র ক্যাডার থেকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ হয়েছে, সেই পদে বাইরে থেকে কর্মকর্তা এনে নিয়োগ দেওয়া কতটুকু প্রয়োজন ছিল জানি না। তাও আবার অবসরে থাকা একজনকে, যেখানে আমরা এত (বেশি) অফিসার রয়েছি। আমাদেরকে তো তাহলে বঞ্চিত করা হলো।’

আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘পররাষ্ট্র ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে পারবেন না। তাহলে আমাদের বঞ্চিত করে অবসরে থাকা সচিবকে কেন রাষ্ট্রদূত করা হচ্ছে? আমাদের সাথে এই বৈষম্য কেন? রাষ্ট্রদূত করতে হলে আমাদের মধ্যে থেকেই কাউকে নিতে পারে।’

এদিকে, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া সরকারের সিদ্ধান্ত তবে পররাষ্ট্র ক্যাডারের বাইরে থেকেও কাউকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর ব্যবস্থা বলে মনে করেন না কূটনীতিবিদরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রথাগতভাবে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র ক্যাডার থেকে এবং বাকি ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত সিভিল ও মিলিটারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমার ব্যক্তিগত মতামত যে, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ সরকারের সিদ্ধান্ত তবে দক্ষতা ও সক্ষমতার বিচারে এটা (পররাষ্ট্র ক্যাডারের বাইরে থেকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ) যে খুব কার্যকর ব্যবস্থা না। কূটনীতি একটি বিশেষায়িত পেশা। এটা দেশের ভেতরের পেশা না বরং একেবারেই ভিন্ন জগতের পেশা। এর ব্যবস্থাপনা, শিষ্টাচার, শিক্ষা একেবারেই ভিন্নরকম। কাজেই যাদের মূল পেশা কূটনীতি না বা যারা বাইরে থেকে আসেন, তারা খুব ভালো কিছু করতে পারেন বলে মনে হয় না। এতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়, রাজনীতি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কিন্তু পেশাগতভাবে খুব বেশি কাজে আসে বলে মনে হয় না।’

বাইরে থেকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগে পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত অনুভব করাটা যৌক্তিক বলেও মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাইরে থেকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হলে পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত অনভব করাটাই যৌক্তিক। রাষ্ট্রের প্রতিটা সংস্থার কাজ নির্ধারিত রয়েছে এবং প্রতিটি সংস্থারই নিজ নিজ কাজ করা উচিত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *