
“আন্তর্জাতিক নারী দিবসে” নারীর নিরাপত্তা,ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের দাবি
ঢাকা : আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচী আয়োজন করে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস কমিটি’। আজ শুক্রবার সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন এবং সমানাধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এসময় নারী অধিকার কর্মীরা বেশ কয়েকটি দাবিও তুলে ধরেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য তুলে ধরে কর্মসূচীতে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে কাগজে-কলমে, বক্তৃতায় নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমাগত বাড়ছে। জুলাই-পরবর্তী যে বৈষম্যহীন ও ন্যায়সঙ্গত বাংলাদেশ আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, তা আমাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই ২,৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আর এ বছরের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতেই মোট ৩৯৪ টি সহিংসতার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে যার মধ্যে ৯৭ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩১ জন। শুধু জানুয়ারিতেই যৌন নিপীড়ন, যৌতুকসহ বিভিন্ন কারণে ১১ কন্যাসহ ৪৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্যাতিত ১৮৯ জনের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১০ জন, এর মধ্যে ৬ জন কন্যাশিশু। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ১৫ জন। গৃহকর্মী নির্যাতনের ৩ টি ঘটনা ঘটেছে, এবং ২ জন গৃহকর্মীকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এগুলো শুধুমাত্র প্রকাশিত খবর ও রিপোর্টেড কেস থেকে প্রাপ্ত তথ্য, এর বাইরেও ঘরে-বাইরে নানারকম সহিংসতার শিকার নারীরা হচ্ছেন যা অনেক সময় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায় না।
এ সময় বক্তারা বলেন, সম্প্রতি বাল্য বিয়ের কারণে ১৩ বছরের এক কিশোরী মা সন্তান জন্ম দেয়ার জটিলতা মারা গেছে ঢাকার এক বস্তিতে। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল ১২ বছরে। অপরদিকে গাইবান্ধায় ১৩ বছরের এক কিশোর অপ্রাপ্তবয়স কিশোর দ্বারা সংগবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় যার বিচার বা চিকিৎসা কোনটাই তাকে নিতে দেয়নি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আয়োজিত সালিশে। গাজীপুরে, নারী গার্মেন্টস কর্মী এক কারখানার ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন, চায়ের দোকানে নারীদের ধূমপান নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে, বাড়ি ও রাস্তায় ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির সময়েও নারীদের যৌন আক্রমণ বা ধর্ষণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পাশাপাশি, চলমান গণসহিংসতা, গণপিটুনি, জনসমক্ষে হয়রানি, আদিবাসী নারীদের প্রতি জাতিগত ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের ওপর হামলা ও হুমকি বেড়ে চলেছে। গৃহকর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা-বাগানের নারী শ্রমিক, প্রবাসী নারী শ্রমিক, দলিত-হরিজন সম্প্রদায়ের নারী, যৌনকর্মী নারী-এমনকি কেবল নারী হওয়ায় নারীদের পোশাক এবং চলাফেরার স্বাধীনতাও মৌলবাদ এবং উগ্রবাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। অপরদিকে, বিষয়টিকে জাতীয় সংকট হিসেবে স্বীকার না করে, আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করছে যে অপরাধের হার বৃদ্ধি পায়নি, বরং আগের মতোই রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এই ধরনের বক্তব্য অপরাধীদের জন্য আরো সুযোগ তৈরি করছে এবং তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, পূর্বের মতো অবস্থায় থাকার জন্য বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আন্দোলন করা হয়নি।
আরো বলা হয়, জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা অস্বীকার করা সম্ভব নয়, তেমনি যেকোনো সংকটকালীন ও সংকট-পরবর্তী সময়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন এ বিষয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। অথচ, জুলাইয়ের পর নারীদের অবদান যথাযথ স্বীকৃতিতো পাচ্ছেই না বরং প্রতিদিনই আন্দোলনে নামতে হচ্ছে অন্য ও সহিংসতার প্রতিবাদে। এ অবস্থায় বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও উগ্রবাদ নিরসনে আমরা আমাদের দাবিগুলো সমস্বরে জানানোর জন্য একত্রিত হয়েছি।
এ সময় সংগঠনটির পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দাপ্তরিক বা অধিকারভিত্তিক কমিটি, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নারীর সমান উপস্থিতি ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; পাশাপাশি, জুলাই অভ্যুথানের নারী সহযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. নারী, কন্যাশিশু, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সম্প্রদায়িক ও গণসহিংসতা বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং মৌলবাদী ও উগ্রবাদী সংস্কৃতির বিস্তার রোধ করতে হবে। ৩. ধর্ষণ, যৌতুক, যৌননিপীড়ন ও উক্ত্যক্তকরণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী প্রচলিত আইনসমূহ নারীর বৈচিত্রময় বাস্তব অভিজ্ঞতা, সর্বোচ্চ স্বার্থ ও সম-অধিকার বিবেচনায় সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে।
৪. আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, গৃহকর্মী, গার্মেন্টস কর্মী এবং অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী ও প্রবাসী নারীদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে জাতিগত ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৬. প্রতিবন্ধী নারীর জন্য গণপরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান ও বিচারব ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ প্রবেশগম্য করতে হবে এবং বিশেষ সহায়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. প্রতিটি জেলায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, নারীসহায়তা ও তদন্ত বিভাগ, কাউন্সেলিং, সাইবার সাপোর্ট ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৮. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা ডিজিটাল প্লাটফর্মে সংঘবদ্ধ নারীবিদ্বেষী কার্যক্রম ও প্রচার নিষিদ্ধ করতে কঠোর সাইবার আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৯. প্রতিবন্ধী, গৃহকর্মী, প্রবাসী, গার্মেন্টস কর্মী, চা-বাগান শ্রমিক, দলিত ও অন্যান্য সংখ্যালঘু নারী ও লিঙ্গবৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
১০. নারীর প্রতি সহিংসতা বিরোধী আইন, নারীর অধিকার ও সহায়তা সংক্রান্ত সকল ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম ও বাস্তব জীবনে বিশেষ প্রচারণা চালিয়ে তৃণমূল ও প্রান্তিক নারীদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দিতে হবে।
১১.সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলসহ সকল স্তরে বয়সভিত্তিক জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও ইতিবাচক যৌনশিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক নারী দিবস কমিটি-২০২৫ সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- উইমন উইথ ডিসাবিলিটিস, কর্মজীবী নারী, শক্তি ফাউন্ডেশন, লাইট হাউস, একশন এইড বাংলাদেশ, সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশন, ব্রতী, ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স, ফুলকি, নারী মৈত্রী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, সেচতন হিজড়া অধিকার সংঘ, বাদাবন সংঘ, এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, সাদা, কেয়ার বাংলাদেশ, সেভ দ্যা চিলড্রেন বাংলাদেশ, পিডাপ, ব্যাঞ্জনা ফাউন্ডেশন, জীবন গঠন উন্নয়ন সংস্থা, সেক্স ওয়ারকার্স নেটওয়ার্ক, উল্কা নারী সংঘ, কল্যানময়ী নারী সংঘ, জীবনের আলো, অগ্নি ফাউন্ডেশন, আওয়াজ ফাউন্ডেশন, সম্পুর্না, বহ্নিশিখা, দুর্জয় নারী সংঘ, গার্লস গাইড এসোসিয়েশন, সম্ভব ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ওশ ফাউন্ডেশন, ব্লাস্ট, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ারকার্স সলিডারিটি, দুর্বার নেটওয়ার্ক, পসিবিলিটি, প্রান্তজ ফাউন্ডেশন, অবেহিলত নারী সংঘ, ৪০ আপ বাংলাদেশ, কোয়ালিশন ফর আরবান পুওর, কোস্ট ফাউন্ডেশন, সোসাইটি ফর পার্টিসিপেটরি এডুকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এসপিইডি), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি, লাল সবুজ সোসাইটি, আশার প্রদীপ, আভা, বিএনএসকে, নারীপক্ষ।